জেসিকা রাখি গোমেজ
নাস্তিকতা নিয়ে ব্লগে লিখালিখি করে ৮ মাসের মধ্যে ৪জন মেধাবী, শিক্ষিত, গুণী ব্লগারকে হত্যা করা হয় ২০১৫ সালের দিকে। তারা হলো অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর রহমান বাবু, অনন্ত বিজয় দাস, নিলয়চ্যাটার্জী (Library of Congress, 2015) (CNN, 2016) (BBC, 2015)। ২০১৩ সালের দিকে রাজীব হায়দার নাম আর একজন ব্লগারকে তারই বাসার সামনে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এদের মধ্যেঅভিজিৎ রায় একজন স্বনামধন্য বাংলাদেশী–মার্কিন লেখক ছিলেন । যেকোনো ভদ্র, মানবিক সমাজে অন্যায় ভাবে খুন করার দায়ে খুনিদের শাস্তির ব্যবস্থা করা হতো, কিন্তু বাংলাদেশে প্রকাশ্যে নিহতব্লগারদের ধর্ম নিয়ে লেখালেখি করার বিরুদ্ধে মন্তব্য করা হয় যা এই হত্যাকান্ড গুলোকে ন্যায্যতা দেয়। ‘ধর্ম নিয়ে লেখালেখি করে কারো ধর্মানুভুতিতে আঘাত না দিলেই তো আজ এই সকল ব্লগার রা খুনহতো না‘- এটাই ছিল বাংলাদেশের সরকারি উচ্চপদস্থ লোকদের প্রকাশ্য মন্তব্য (CNN, 2016), এমনকি বেশিরভাগ সুশীল সমাজের শিক্ষিত শান্তিপ্রিয় মানুষদের ও একই মন্তব্য ছিল আর অশিক্ষিত, গরিব, গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারীদের কি মন্তব্য হতে পারে তা কি বলার প্রয়োজন থাকতে পারে?
এর পরে ২০১৬ সালে রাজশাহীতে একজন ইংরেজি প্রফেসরকে একজন ছাত্র গলায় ছুরিকাঘাত করে (Graham-Harrison & Hammadi, 2016), যার কারণ দর্শিয়ে ইসলামিক স্টেট অনলাইন এবার্তা দেয় যে নাস্তিকতা প্রচারের দায়ে তার এ খুন যথাযোগ্য (Tharoor, 2016)। এরই দুইদিন পরে ঢাকায় সমকামী এক্টিভিস্ট জুলহাস মান্নান ও তার বন্ধু তনয় মজুমদারকে তাদেরই বাসায় কুপিয়েহত্যা করা হয় এবং সূত্রমতে তাদের হত্যার পর খুনিরা ‘আল্লাহু–আকবার‘ বলে প্রস্থান করে (Tharoor, 2016)। প্রথমে ব্লগারদের তারপর যারা নাস্তিকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতা প্রচার করে তাদের, এরপরসংখ্যালঘুদের ও সেইসব মুসলিমদের ওপর আক্রমণ চালানো হয় যারা বাংলাদেশকে চরমপন্থী ইসলামিক সমাজে পরিণত হতে দিতে চায় না (Graham-Harrison & Hammadi, 2016)। ২০০৪সালের ২৭ শে ফেব্রুয়ারী প্রথা–বিরোধী লেখার দায়ে মৌলবাদ জে এম বি হামলা চালায় বাংলাদেশের প্রখ্যাত লেখক হুমায়ুন আজাদের ওপর (Roy, 2014)। এমনকি ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে যেকোনোরচনা প্রকাশের বিরুদ্ধে হুমকি দেয়া হয় বিভিন্ন প্রকাশকদের, কিন্তু এই সকল হুমকির মুখেও মতামত প্রকাশের অধিকার রক্ষার্থে ধর্মনিরপেক্ষ লেখালিখি প্রকাশ করে নিজেরই অফিসে ২০১৫ সালে খুন হনফয়সাল আরেফিন দীপন, জাগৃতি প্রকাশনীর কর্ণধার, যিনি অভিজিৎ রায় এর সর্বাধিক লেখার প্রকাশক ছিলেন (CNN, 2016) (Kumar, 2015)। ওইদিনই অভিজিৎ রায়–এর লেখার আর একজনপ্রকাশক আহমেদুর রাশিদ টুটুল ও হামলার শিকার হন (Kumar, 2015)।
এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকারের ভূমিকা অতুলনীয়, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ধারা ৫৭ ব্যবহার করে ২০১৩ সালের পহেলা এপ্রিল ব্লগারদের খুনিদের গ্রেফতার করার বদলে খোদ ব্লগারদেরগ্রেফতার করে জেলে পুড়ে দেয়া হয় আসামির মতো করে (Library of Congress, 2015)। এদের মধ্যে রয়েছে শুভ্রত শুভ, যিনি মুক্তিযুদ্ধের কিছু অজানা তথ্য নিয়ে লিখালিখি করে, আরেকজন রাসেলপারভেজ, যিনি আমেরিকা থেকে উচ্চ শিক্ষা নিয়ে মাতৃভূমির টানে অর্থনৈতিক সমবৃদ্ধি ও উচ্চমানের জীবনযাত্রা ছেড়ে দেশে ফিরে এসে স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। এদেরকে আসামির মতো হাতকড়াপরিয়ে জেলে পুরা হয় এবং আরো ৮৪ জন ব্লগারের লিস্ট প্রকাশ করা হয় গ্রেফতার করার জন্য (Roy, 2014)। এই ৫৭ ধারা মূলত স্বাধীনমত প্রকাশের অধিকারকে ক্ষুন্ন করার জন্যই ব্যবহার করা হয়কিন্তু একে সাজানো হয়েছে অন্য মোড়কে ! এই ধারায় বলা হয়েছে, এমন সব প্রকাশনা যাতে আইন ও আদেশ ক্ষুন্ন হওয়ার মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় এবং যা ধর্মানুভুতিতে আঘাত করে বা একে অন্যেরবিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ করে, সে ধরণের প্রকাশনা বা রচনা একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ধর্মগ্রন্থে বিধর্মীদের প্রয়োজনে খুন করার কথা লিখা থাকবে, কারো চোখে তা ত্রুটিপূর্ণ মনে হলে বলা যাবে না, কারণ তাতেঅন্যের ধর্মানুভুতিতে আঘাত লাগে ! সেই ধর্মানুভূতি যা অন্ধ, যা ঠিক –ভুল, সাদা–কালোর মধ্যে তফাৎ করতে জানে না ! কিন্তু প্রশ্ন করা, মন্তব্য করা যাবে না তাতে ধর্মানুভুতিতে আঘাত লাগে যা একটিশাস্তিযোগ্য অপরাধ ! তাহলে স্বাধীনমত প্রকাশের অধিকার রইলো কোথায় ?
কিছু কিছু ব্লগার বিদেশে আশ্রয় চেয়ে আবেদন করেও ব্যর্থ হয়েছে (Meyer, 2013) (Library of Congress, 2015) (The Daily Star, 2015)। তাহলে কি আস্তে আস্তে পুরো বিশ্বই একমত পোষণকরবে যে, ধর্মানুভুতিতে আঘাত লাগে এমন কিছু করোনা তাতে যদি তোমার অনাকাঙ্খিত ঘটনার সম্মুখীন হতে হয় বা প্রাণ নাশ হয় সেটা তোমারই কর্মফল, তাই কেউ তোমাকে সাহায্য করবে না, তোমারপক্ষে কিছু বলবে না । তাদের থামাবে না, শাস্তি দেবে না যারা ধর্ম নিয়ে, জীবন নিয়ে, সম–অধিকার ও লিঙ্গ নিয়ে বিজ্ঞানসম্মত প্রমাণনির্ভর যৌক্তিক আলোচনা শুনলেই চাপাতি নিয়ে কোপাতে ছুটে আসে?